মো. রওশন আলম পাপুল, গাইবান্ধা প্রতিনিধি ::
পোত্তমের (প্রথম) দিক মারে নাই। ওমার (তাদের) ছোলট্যা তখন হাঙ্গুর (হামাগুড়ি) দেয়। দাড়াবার ধরি একল্যায় পড়ি যায়্যা কান্দিলে আমাক মারে। কম করি খাবার দিচে। মদ্যে মদ্যে (মাঝে মাঝে) সারাদিন খাবার দ্যায় নাই। কোনদিন একব্যার খিল্যাচে। খিদ্যার যনতোনায় একদিন ফ্রিজের তালা ভাঙ্গি ভাজা মাছ ও মিষ্টি খাচিলুম। তকনো ওরা মোক খুবি মারচে।
ওমরা ঘরমোচা, পায়খানা পরিস্কার করব্যার দিচে। সেগুল্যাও করব্যার না প্যালে (পারলে) নাটি দিয়্যা মারচে। মাজিয়াত (মেঝে) থাকব্যার দিচে। এ্যাংকা (এভাবে) করি করি ওরা মোক শাস্তি দিচে। যার দাগ একনো মোর গায়োত আচে। কথাগুলো বলছিল গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার দরবস্ত ইউনিয়নের মধ্যপাড়া গ্রামের ১৩ বছর বয়সী জেলাল মিয়া। সে ওই গ্রামের সিরাজ উদ্দিনের ছেলে। সে ঢাকায় ধানমন্ডির এক বাসায় গৃহকর্মী থাকা অবস্থায়নির্যাতনের শিকার হয়। কিন্তু সেখান থেকে মিলছে না চিকিৎসার টাকা। ফলে চিকিৎসার অভাবে এখন নানান শারীরিক সমস্যা নিয়ে দিন কাটছে জেলালের।
গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫ অনুযায়ী, প্রত্যেক গৃহকর্মীর কর্মঘণ্টা এমনভাবে বিন্যস্ত করতে হবে যাতে তিনি পর্যাপ্ত ঘুম, বিশ্রাম, চিত্তবিনোদন ও প্রয়োজনীয় ছুটির সুযোগ পান। গৃহকর্মীর ঘুম ও বিশ্রামের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত স্থান নিশ্চিত করতে হবে। গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীর অনুমতি নিয়ে গৃহকর্মী সবেতনে ছুটি ভোগ করতে পারবেন। সেইসাথে অসুস্থ গৃহকর্মীকে কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে এবং নিয়োগকারী নিজ ব্যয়ে তার যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন। এ সমস্ত সুযোগ-সুবিধা তো জোটেইনি উপরন্তু জেলাল অসুস্থ্য হয়ে পড়লে তাকে শুন্য হাতে বাড়ীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বুধবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ঢাকা-রংপুর জাতীয় মহাসড়কের গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ী উপজেলা ঘেঁষা কোমরপুর বাজার। এই কোমরপুর বাজার থেকে ৩০০ মিটার দক্ষিণ দিকে মধ্যপাড়া (বিলপাড়া) গ্রাম। মহাসড়ক থেকে পূর্বপাশে কাঁচা রাস্তা ধরে চার-পাঁচটি বাড়ী পেরোলেই জেলালের বাড়ী। বাড়ীর সামনের ফাঁকা জায়গায় অন্য শিশুরা খেলছে আর দাঁড়িয়ে থেকে তা দেখছে জেলাল।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ১২ বছর আগে বাবা সিরাজ উদ্দিন যক্ষ্মায় ভুগে মারা যান। তিনি বাড়ীর পাশ্ববর্তী কোমরপুর বাজারে কাঁচামালের ব্যবসা করতেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে জেলাল সবার ছোট। বড় দুই ভাই গোলাপ মিয়া (১৭) ও হেলাল মিয়া
(১৬) ঢাকায় কাঠের আসবাবপত্র তৈরির কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেন। জেলাল ও তার মা গোলাপী বেগম জানায়, ২০১৯ সালের মার্চে প্রতিবেশি গোলজার রহমানের স্ত্রী সাহিদা বেগম গোপনে জেলালকে ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় যাওয়ার কথা বলেন।
সেখানে সে পাশ্ববর্তী পলাশবাড়ী উপজেলার বরিশাল ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের মফিজুল হকের ছেলে মো. রিয়াদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করবে আর এক বছর বয়সের শিশুর সাথে খেলা করবে। এজন্য প্রতি মাসে তিন হাজার টাকাও দিতে চাওয়া হয় জেলালকে। এতে জেলাল রাজিও হয়। কথা অনুযায়ী একদিন ভোররাতে একটি মাইক্রোবাসে করে ধানমন্ডির বাসায় যায় জেলাল। সেখানে কারণে-অকারণে রিয়াদ ও তার স্ত্রী নির্যাতনের শিকার হয় জেলাল। জেলাল বাড়ী যেতে চাইলে তারা বলতো- সামনের মাসে যাবো। এভাবে কেটে গেছে ২৫ মাস। এই সময়ে বাড়ীতে মা-ভাইয়ের সাথে কথা বলার সময় জেলালকে ভয়-ভীতি দেখানো হতো যাতে নির্যাতনের কথা সে বলতে না পারে। এমনকি তাদেরকে দেওয়া হয়নি ঢাকার ঠিকানাটাও।
পরে নির্যাতনের একপর্যায়ে জেলাল অসুস্থ্য হয়ে পড়লে মো. রিয়াদের কর্মস্থলের এক যুবকের সাথে চলতি বছরের ৬ মে সকালে গ্রামের বাড়ীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় জেলালকে। পরে গ্রামবাসী জেলালের কাছে নির্যাতনের বিবরণ শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সেদিনই দুপুরে তারা কোমরপুর বাজারে ঢাকা-রংপুর জাতীয় মহাসড়ক প্রায় দুই ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন। পরে গোবিন্দগঞ্জ থানা ও হাইওয়ে পুলিশ চিকিৎসা সহায়তার আশ্বাস দিলে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। এমনকি যারা নির্যাতন করেছে তারাও দিচ্ছেন না চিকিৎসার টাকা।এ অবস্থায় অসহায় মা গোলাপী বেগম তার ছোট দুই বোনের কাছে ১৫ হাজার টাকা ঋণ করে কোনমতে জেলালের চিকিৎসা করেন। এখন টাকার অভাবে চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে জেলালের।
জেলালের কয়েকজন প্রতিবেশি জানায়, জেলালকে যখন বাড়ীতে পৌঁছে দেওয়া হয় তখন তার বুকের হাড় একটি একটি করে গোনা যাচ্ছিল। অসুস্থ্যতায় মুখ থেকে কথা বেরোচ্ছিলই না। থাকতে পারছিল না দাঁড়িয়েও। দশা এমন- যেন মৃত্যুশয্যা।জেলাল জানায়, এখনো বুকে-কোমরে ব্যথা করে। মাথা ঘোরে। ডান কানে কম শুনতে পাই। ভারি কোন কাজ করতে পারিনা। ২৫ মাসে ৭৫ হাজার টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও পেয়েছি মাত্র ৫৪ হাজার টাকা। পড়ালেখা করার আগ্রহও প্রকাশ করে জেলাল।
মা গোলাপী বেগম বলেন, ছেলেকে দেখার জন্য ভিডিওকল দিলে তারা একেকদিন একেক ধরনের কথা বলে এড়িয়ে যেতেন। তারা ছেলেটাকে এভাবে নির্যাতন করবে ভাবতে পারিনি। জেলালকে বগুড়ার একটি ক্লিনিকে মাত্র চারদিন চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর বাহিরে তারা আর কিছুই করেনি। ছেলের চিকিৎসার দাবি করেন তিনি। শুধু তাই নয়, ওরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ যাতে নিতে না পারি সেজন্য আমাকে ভয়ভীতি দেখিয়েছে এলাকার লোকজন।
মানবাধিকার কর্মী আইনজীবি সালাহউদ্দিন কাশেম বলেন, শিশু নির্যাতন একটি ফৌজদারী অপরাধ। যা জামিন অযোগ্য। যাদের দ্বারা শিশুটি নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদেরই উচিত তার পুরো চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া। এক্ষেত্রে সে তার অধিকার বঞ্চিত হয়েছে। তাদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া দরকার। যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
সকল অভিযোগ অস্বীকার করে মো. রিয়াদ বলেন, জেলালের কোন শারীরিক সমস্যা আছে কিনা সেজন্য বগুড়ার একটি ক্লিনিকে ১২দিন রেখে চিকিৎসা ও সকল পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয়। এতে প্রায় ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়। তারপর সেখানকার চিকিৎসক জেলালকে সুস্থ্য বলার পর তাকে তার মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এ সংক্রান্ত সকল সনদ তাদেরকে এক কপি দেওয়াও আছে। তবে জেলালের জন্মগত রক্তশুন্যতা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে গাইবান্ধা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ফজলুল হক বলেন, সমাজকল্যাণ পরিষদের মাধ্যমে অনুদান দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী আবেদন করলে বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর পাঁচ হাজার টাকা থেকে শুরু করে তারও বেশি
সাহায্য পেতে পারে জেলাল।