জুন মাসে দেশে ক্রসফায়ার ২০, গণগ্রেফতার ৭৭৮৫ ও আত্মহত্যা ৫৪

প্রেস বিজ্ঞপ্তি : জুন মাসে দেশের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি আশানুরুপ নয় বলে মনে করে দেশের অন্যতম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা। জুন মাসে ক্রসফায়ারে নিহতের ঘটনা ছিল উদ্বেগজনক যা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লংঘন ও আইনের শাসনের পরিপন্থি। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় নিহত ও আহত, শিশু ধর্ষণ, গণ ধর্ষণ,পারিবারিক ও সামাজিক কোন্দলে আাহত ও নিহত, গৃহকর্মী নির্যাতন ও খুন, নারী নির্যাতন, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার জুন মাসের মনিটরিং-এ পাওয়া তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়:
ক্রস ফায়ারে নিহত ঃ জুন মাসে ক্রস ফায়ারে মৃত্যু হয় ২০ জনের, এর মধ্যে পুলিশের ক্রস ফায়ারে নিহত হয় ১৬ জন, র্যাব কর্তৃক নিহত ৪ জন । ১৮ জুন মাদারীপুরে শিক্ষক হত্যাচেষ্টার মামলার অভিযুক্ত গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম পুলিশ রিমান্ডে থাকা অবস্থায় বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়। পুলিশ, র্যাব ও যৌথ বাহিনীর সাথে বন্দুক যুদ্ধে যেখানে জানুয়ারী থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৩৩ জন নিহত হয় সেখানে জুন মাসেই নিহত হয় ২০ জন।
সামাজিক অসন্তোষ ঃ প্রলম্বিত বিচার পদ্ধতি, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এই সবকিছু মিলেই দেশের আপামর জনসাধারনের মানসিক ও মানবিক চিন্তা চেতনার অবক্ষয়ের কারনে বেড়ে গেছে সামাজিক অসোন্তুষ আর এই সামাজিক অসন্তোষের শিকার হয়ে এই মাসে নিহত হয়েছেন ২১ জন ! আহত হয়েছেন ৮৩০ জন। সামাজিক সহিংসতায় মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। হবিগঞ্জের সুতাং রেল স্টেশনে তুচ্ছ ঘটনায় দশ গ্রাম বাসির মধ্যে সংঘর্ষে দেড় শতাধিক আহত হয় । জানুয়ারী থেকে জুন ৬ মাসে সামাজিক সহিংসতায় আহত হয় ৩১৮৮ জন। বেশীর ভাগ ঘটনাই ঘটেছে জমি জমা, দুই গ্রামের খেলা নিয়ে সংঘর্ষ বা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
ধর্ষণ ঃ জুন মাসে মোট ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৯ জন নারী ও শিশু । এদের মধ্যে শিশু ১০ জন। ১২ জন নারী। ৫ জন নারী গণ ধর্ষণের শিকার হয় । ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২ জনকে। ৬ জুন যশোরে প্রতিপ্রক্ষকে ভোট দেওয়ার অপরাধে এক গৃহবধূকে গণধর্ষণ করা হয়। ১২ জুন পটুয়াখালী বাউফল উপজেলায় মা ও মেয়েকে একসাথে গনধর্ষন করা হয়। বছরের প্রথম তিন মাসে যেখানে ৬৬ জন নারী ও শিশু ধর্ষনের শিকার হয় সেখানে বিগত তিন মাসে এপ্রিল-জুন মাসে ধর্ষনের শিকার হয় ১০৩ জন।
ইউপি নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা ঃ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় কেন্দ্র প্রতিদ্বন্ধি প্রার্থী ও সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতায় জুন’ ১৬ মাসে নিহত হয় ২০ জন এবং আহত হয় ৫৯০ জন। এছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক কারনে আহত হয় ২৯০ জন ও নিহত হন ৩ জন। জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত উনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতায় নিহত ১৩৪ জন ও আহত ৪৯০৫ জন।
শিশু হত্যা ঃ জুন মাসে ১৩ শিশুকে হত্যা করা হয় । নির্যাতনের শিকান হয় আরো ৪ জন । লক্ষীপুরে পারিবারিক কলহের জেড় ধরে দেড় মাস বয়সী এক শিশুকে হত্যা করে শিশুটির মা । ভাঙ্গায় নিখোজ হওয়ার ৪৪ ঘন্টা পর ৪ মাস বয়সী এক শিশুর লাশ উদ্বার করা হয়। ১২ জুন চকরিয়ায় সিএনজি ট্যাক্সির ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটির সময় চালকের ঘুষিতে মায়ের কোলে থাকা আট মাসের শিশুর মৃত্যু হয়।
আত্মহত্যা ঃ জুন মাসে আত্মহত্যা করেছে ৫৪ জন । এদের মধ্যে ২৫ জন পুরুষ ও ২৯ জন নারী। ২৮ জন নারীর মধ্যে ২ জন গৃহকর্মী। বছরের প্রথম ছয় মাসে মোট ২৩৬ জন আত্মহত্যা করে, ২০১৫ সালের প্রথম ছয় মাসে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে ১৯০টি। পারিবারিক দ্বন্দ্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, অভিমান, রাগ ও যৌন হয়রানী, পরীক্ষায় খারাপ ফল, এমনকি পছন্দের পোষাক কিনতে না পারার কারনেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় মাদকাসক্ত পিতার উপর অভিমান করে এক দশম শ্রেনীর এক ছাত্রী কীটনাশকপানে আত্মহত্যা করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
যৌতুকঃ জুন মাসে যৌতুকের কারনে প্রাণ দিতে হয়েছে ৭ জন নারীকে । নির্যাতনের শিকার হয় ১২ জন। রাজশাহীর পবায় গৃহবধূকে শ্বাসরোধে হত্যা করে স্বামী ও শ্বাশুড়ী । নারায়নগঞ্জের রুপগঞ্জে যৌতুকের টাকা না পেয়ে স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ীর লোকজন রানী সরকার ও সারজিদা নামে দুই গৃহবধূকে নির্মম অত্যাচার করে ।
পারিবারিক কলহঃ পারিবারিক কলহে জুন মাসে নিহত হন ১৩ জন, এদের মধ্যে পুরুষ ১১জন ,নারী ২ জন।। তাছাড়া বিভিন্ন কারনে জুন মাসে স্বামীর হাতে নিহত হন ১১ জন নারী। পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে দ্বন্ধ, রাগ, পরকীয়া সহ বিভিন্ন পারিবারিক কারনে এই সব মৃত্যু সংগঠিত হয় বলে জানা গেছে।
খুন ঃ জুন মাসে দেশে সন্ত্রাসী কর্তৃক নিহত হন ৮৯ জন ও আহত হয় ২২ জন। ২ জুন রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় আব্দুল বারেক সরদার কে নিজ ঘরে গলা কেটে হত্যা করে দুবৃত্তরা । তাছাড়া দিনে দুপুরে চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খাতুন মিতুকে নির্মম ভাবে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে জঙ্গীরা। প্রতিবেদন অনুযায়ী একই দিনে পৃথক ঘটনায় রাজধানীর উত্তরায় এক সেনা কর্তকর্তার বৃদ্ধ মা সহ দুইজনকে হত্যা করে দূর্বৃত্তরা। একই দিনে নাটোরের খ্রিস্টান ব্যবসায়ী সুনিল গোমেজ মন্টুকে জবাই করে হত্যা করা হয় । ৮ জুন ঝিনাইদহের এক বৃদ্ধ পুরহিত আনন্দ গোপাল আনন্দ গাঙ্গওলীকে দিন দুপুরে কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করে দূর্বৃত্তরা। ১০ জুন পাবনায় অনুকুল চন্দ্র ঠাকুর আশ্রমের সেবাকর্মী নিত্তরঞ্জন পান্ডেকে কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করে দূর্বৃত্তরা।
অন্যান্য সহিংসতার ঘটনাগুলোর মধ্যে, মাদকের প্রভাবে বিভিন্ন ভাবে নিহতের সংখ্যা ২ জন, আহত হয় ২৬ জন। সড়ক দূর্ঘটনায় এ মাসে নিহত ২১২ ও আহত ২৮৪ জন। তাছাড়া পানিতে ডুবে, অসাবধানবসত, বিদ্যুৎপৃস্ট হয়ে, বজ্রপাতে মৃত্যুবরন করেছে ৭০ জন। গণপিটুনিতে নিহত হয় ৫, বোমা বিস্ফোরনে আহত ৪ জন, তাছাড়া ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী কর্তৃক নিহত হয় ২ জন। চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয় ২ জনের। জঙ্গি ও সন্ত্রাসী দমন অভিযানের নামে গনগ্রেফতার করা হয় ৭৭৮৫ জনকে। শ্রমিক অসন্তোষে ও আন্দোলনে আহত হয় ৮০ জন শ্রমিক।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা মনে করে বিদ্যমান মানবাধিকার লংঘন অব্যাহত থাকলে একদিকে যেমন দেশের অগ্রগতি ব্যাহত হবে অন্যদিকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গিকার তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে । আইনের সঠিক প্রয়োগ, অপরাধিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, নৈতিক অবক্ষয় রোধে বিভিন্ন পর্যায়ে কাউন্সিলিং, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ, ভালো কাজের জন্য পুরষ্কার, সামাজিক সংগঠন গুলোর বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব বলে মনে করে সংস্থাটি।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা ৭৯ ধরনের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার তথ্য সংরক্ষণ করে। তার মধ্যে প্রতি মাসে আলোচিত ও উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনার তথ্য গনমাধ্যমে প্রকাশের জন্য প্রেরণ করা হয় । উল্লেখ্য এ মাসে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সার্বিক গবেষনা তথ্য মোতাবেক এসকল ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ ( আহত ও নিহত) হয় মোট ১০,৬১২ জন নারী , পুরুষ ও শিশু।
(তথ্য সুত্রঃ জুন ২০১৬ মাসে দেশে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিক পত্র-পত্রিকা এবং সংস্থার বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও পৌরসভা শাখার মাধ্যমে সংগৃহিত তথ্য। এর বাইরেও মানবাধিকার লংঘন জনিত কিছু ঘটনা থাকতে পারে যা আমাদের সীমাবদ্ধতার কারনে সংগ্রহ করা সম্ভন হয়নি)
You must log in to post a comment.
0 Comments